হানাফিরা মুশরিক, আহলে হাদিসরা কাফির : দুই প্রান্তিকতার ইতিবৃত্ত


—মুনিরুল ইসলাম ইবনু জাকির

অধিকাংশ আহলে হাদিসরাই মনে করে—হানাফি মানেই কবরপূজারী, পীরপূজারী মুশরিক, বিদয়াতি। তারা মনে করে—হানাফিরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে বাদ দিয়ে ইমাম আবু হানিফার মাযহাব মানে। এ জন্য হানাফি শব্দটাই তাদের কাছে শিরক-বিদয়াতের দুর্গন্ধযুক্ত।
.
ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দিন নামে আহলে হাদিসের এক বড় মাপের গবেষক আছেন। ভদ্রলোকের যাবতীয় গবেষণার সারমর্ম এটাই যে, মাযহাবিরা মুশরিক। কীভাবে? খেয়াল করুন—“আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা ঐসব মুশরিকদের মতো হয়ো না যারা নিজেদের দীনকে খন্ডবিখন্ড করেছে৷’ সুতরাং চার মাযহাবের নামে যারা ইসলামকে চারভাগ করেছে, তারা সবাই মুশরিক!”

কী চমৎকার লজিক! আমি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বেশ ক’বছর আগে প্রশ্ন করেছিলাম—‘আচ্ছা, তাহলে আহলে হাদিসরা যে আজকে কয়েক ডজন দলে ভাগ হয়েছে, এরাও কি মুশরিক হবে? আর আপনি নিজেও তো একটা আহলে হাদিস দলের দায়িত্বশীল, আপনার হুকুম কী হবে?’ ভদ্রলোক যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। অ্যাঁ, উঁ করে কিছু বলতে চাইছিল। যাহোক, উনি তো সাধারণ একজন ইঞ্জিনিয়ার। উনার কথা না হয় বাদই দিলাম।
.
এক ভাই মরহুম আবদুর রহিম সালাফি সাহেবের একটা বক্তব্যের রেকর্ড শুনিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, “রাম-কৃষ্ণের তরিকায় ইবাদাত করার কারণে যদি হিন্দুরা জাহান্নামে যায়, তাহলে আবু হানিফার তরিকায় আমল করার কারণে হানাফিরা কোথায় যাবে?”

সুবহানাল্লাহ, ইতোপূর্বে আ. রহিম সাহেবকে আহলে হাদিসদের মধ্যে যাদেরকে আমি আলিম মনে করি, তাদের অন্তর্ভুক্ত মনে করতাম। কিন্তু এ বক্তব্য শোনার পরে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আর তার মাঝে কোনো তফাৎ খুঁজে পেলাম না।
.
এবার আসি অপর প্রান্তে। কিছু দিন আগে চট্টগ্রামের এক ট্রেডমার্ক হক্কানি বক্তার আলোচনা শুনছিলাম—বক্তব্যের প্রতিপাদ্যই ছিল ‘আহলে হাদিসরা কেন কাফির?’ গতকাল এক ভাই সাগরপাড়ের সেলিব্রিটি এক বক্তার বক্তব্যের একটা লিংক দিলেন, সেখানে তিনি একেবারে অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন যে, আহলে হাদিসরা কাফির!

কীভাবে? খেয়াল করুন—“আহলে হাদিসরা শুধু কালিমার তাওহিদ অর্থাৎ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অংশটুকু মানে, কিন্তু রিসালাতের অংশ তথা ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ মানে না! সুতরাং যারা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ মানে না, এরা মুসলমান হতে পারে না৷ এরা কাফির-বেইমান, কাদিয়ানির এজেন্ট...(আকাশ-বাতাস ভারী শ্লোগান)!”
.
আসুন, এবার একটু সামঞ্জস্য করি। খুব ভালো করে দেখুন তো, প্রথম প্রেক্ষাপটের সাথে এটার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন কিনা? হ্যাঁ, এখানে যে জিনিসটা একেবারে খাপেখাপ মিলে যায়, সেটা হলো তথ্যবিভ্রাট বা তথ্যবিকৃতি।
আহলে হাদিসদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে, পুরো হানাফি জামায়াতটাই যেন কবরপূজা, পীরপূজাসহ হাজারও শিরক আর বিদয়াতে পরিপূর্ণ। অথচ বাস্তবতা হলো, এই কবরপূজারির দল হানাফি মাযহাব তো দূরের কথা দীন-ইসলামেরই কোনো ধার ধারে না। বিদয়াত এবং বিদয়াতির সাথে মুবারক এই মাযহাবের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আর এদের দোষ মাযহাবের উপর চাপানোর যৌক্তিকতাই বা কী?

খুলে দেখুন হানাফি মাযহাবের কিতাবসমূহ। এসব কিছুকেই হারাম এবং কুফর বলা হয়েছে। যুগে যুগে হানাফি মাযহাবের ইমামগণ আকিদার উপর বড় বড় কিতাব লিখে গেছেন। স্বয়ং ইমাম আযম আকিদাহ সংক্রান্ত ইলমকে নামকরণ করেছেন আল-ফিকহুল আকবার হিসেবে। ইমাম আযমের ‘ফিকহুল আকবার’ এবং মুল্লা আলি কারি রহ.কৃত শরাহ, ইমাম তাহাবি আল-হানাফির ‘আকিদাতুত তাহাবিয়্যাহ’ এবং ইমাম ইবনু আবিল ইয আল-হানাফি রহ.কৃত শরাহ আজও সারা পৃথিবীর আকিদার প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত।
সেই ধারাবাহিকতায় এই প্রজন্মের হানাফি উলামা কিরামও রচনা করে চলেছেন আকিদার অসংখ্য কিতাবাদি। যেই হাটহাজারির নাম শুনলেই আপনারা নাক সিঁটকান, সেই জামিয়ার শাইখুল হাদিস আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী (হাফি.) কিতাব লিখেছেন ‘আত-তাওহিদ ওয়াশ শিরক ওয়া আকসামুহুমা’ নামে; যা আরববিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত। সেই মাদরাসারই রইসুল মুফতিয়্যিন আবদুল সালাম চাটগামী (হাফি.)’র তত্ত্বাবধানে রচিত হয়েছে আকিদার এক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব—‘মুসলিম হতে হলে আপনাকে যা অবশ্যই জানতে হবে’। পড়ুন, হাদিসশাস্ত্রের নক্ষত্র মাওলানা আবদুল মালিক সাহেবের কিতাবগুলো।
যেই শিরক আর বিদয়াতের ‘অপবাদ’ আপনারা হানাফিদের উপর চাপাচ্ছেন, সেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েই তাঁরা রক্ত-ঘাম ঝরিয়েছেন, জান পর্যন্ত কুরবান করেছেন।
.
অপরদিকে কালিমা অস্বীকারের যে অপবাদ আহলে হাদিসদের উপর দেয়া হচ্ছে, এটাও স্রেফ তথ্যবিভ্রাট অথবা স্বেচ্ছা মিথ্যাচার৷ গত ছ’বছরে আহলে হাদিসদের এমন কোনো অঞ্চল নাই আমি সফর করি নি৷ কুমিল্লা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, পুরান ঢাকা, গাজীপুর, ভালুকা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সৈয়দপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নিলফামারি, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নওগাঁ, রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, খুলনা, বাগেরহাট, মংলা...এসব এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে তাদের বসবাস। এই প্রত্যেকটা এলাকাই আমি সফর করেছি। হাজার হাজার না, লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে মিশেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন—ওয়াল্লাহি, আমি একজন আহলে হাদিসকেও পাই নি, যে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহকে অস্বীকার করে। বরং আহলে হাদিসদের বড় বড় মসজিদে মিহরাবের উপরাংশে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লেখা পেয়েছি। আহলে হাদিসের বড় আলিম আকরামুয যামান বিন আবদুস সালাম সাহেব তার লেখা ‘কালিমার মর্মকথা’ বইয়ের শেষের দিকে যারা কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ একত্রে লেখাকে শিরক বলে তাদের যুক্তি খন্ডন করেছেন। আরও কয়েকজন আহলে হাদিস আলিমের লেখা আমি এ ব্যাপারে পড়েছি।
.
হ্যাঁ, সর্বপ্রথম এই কথাটা আমি শুনেছিলাম জামায়াতনেতা তারেক মনোয়ারের এক বক্তব্যে। এরপর বংশালে এক মহিলার ব্যাপারে জেনেছিলাম এই দর্শনে বিশ্বাসী। সর্বশেষ এই বছরের শুরুর দিকে আরেকজনের দেখা পেয়েছিলাম সুরিটোলায়।
এদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম—তারা কক্ষণই ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এটা অস্বীকার করেন না। বরং কালিমা তাইয়িবাহ আমরা যেভাবে পাঠ করি (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। অর্থাৎ ওয়াও বা ‘আতফ’ ছাড়া) এটাকে তারা ঠিক মনে করেন না। অবশ্য আমি তাদেরকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট দলিল-আদিল্লাহ পেশ করেছি যে, এভাবে বলা বৈধ। কিন্তু তারা মানতে নারাজ।
এখন কথা হলো, এ কারণে কি তাদেরকে তাকফির করা যাবে? কারণ, বৈয়াকরণিক ভুলে কেউ যদি কুফরিও করে ফেলে সেক্ষেত্রেও তো তাকফিরের ব্যাপারে সতর্কতা আছে৷
.
তাহলে এবার দিলখোলাভাবে বলুন তো, আহলে হাদিসদের প্রতি আমরা কতটুকু ইনসাফ করতে পেরেছি। আমার কানে এখনও বাজছে, সেই বক্তা বলছিলেন, “এরা তো কালেমাই মানে না, এরা কিসের মুসলমান? এরা কখনোই মুসলমান না, এরা ইহুদি-খৃস্টানের দালাল...।”
.
তাহলে ঘটনা কী দাঁড়াল? কতিপয় কুবুরি, কুতুবি, মাযারপূজারির কারণে ওরা মুবারক হানাফি মাযহাবটাকেই দোষী করছে। আর আমরাও কতিপয় লোকের কিছু ভ্রষ্টামি সামনে এনে পুরো আহলে হাদিস জামায়াতটাকেই তাকফির এবং তাদলিল করছি। উভয় গ্রুপেরই সমস্যা এক জায়গায়। কেউ কারও ব্যাপারে সঠিক তথ্য জাতির সামনে পেশ করছে না। কারণ, সঠিক তথ্য প্রকাশ করলে মাঠ গরম হবে না, শ্লোগান ওঠবে না, বরং ইমানি উখুওয়াতের এক নীরব সমীরণ বয়ে যাবে হৃদয়ে।
.
শেষকথা:
এই তথ্যবিভ্রাট বা স্বেচ্ছা তথ্যবিকৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে। যাতে বাগদাদের সেই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের পুনরাবৃত্তি না হয়।

1 টি মন্তব্য:

  1. Fair Play Casino - Xn--o80b910a26eepc81il5g.online
    Fair Play Casino - Xn--o80b910a26eepc81il5g.online. 메리트카지노총판 © 제왕카지노 2020 Xn--o80b910a26eepc81il5g.online. © 2020 Xn--o80b910a26eepc81il5g. deccasino

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.